“হরিষে বিষাদ” প্রকাশিত: ৬:০৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২১, ২০২২ | আপডেট: ৬:২৬:অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২১, ২০২২ এস এম মোস্তফা কামাল। সাবেক জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা। ফুটবল পাগল বাংলাদেশীদের জন্য একরাশ শুভেচ্ছা । বিশ্বকাপ শেষ । ফুটবলের যাদুকর মেসির বিশ্বজয় । মেসিময় এবারের বিশ্বকাপ । অভিনন্দন মেসি এন্ড কোং । বাংলাদেশের ফুটবল দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিম্নগামী । একবার কোন সুদুরে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তা বর্তমান প্রজন্ম গুগল না ঘাটলে জানতেও পারবে না । তারা এও জানতে পারবেনা ৮০/ ৯০ দশকে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে আবাহনী ও মোহামেডানের রোমাঞ্চকর ডার্বির কথা । তখন ঢাকা লীগের খেলা হতো বায়তুল মোকাররমের পাশে ঢাকা স্টেডিয়ামে যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধুজাতীয় স্টেডিয়াম নামে পরিচিত । এই দুই দলের খেলা থাকলে দল বেধে সমর্থকেরা স্টেডিয়ামে ঢুকতো । উত্তেজনা আর উন্মাদনায় ভরপুর থাকতো গ্যালারি । বল পায়ে ড্রিবলিং, স্লাইডিং, হেডিং ট্যাকলিং দেখে চিৎকারে প্রকম্পিত হতো পুরো স্টেডিয়াম । আর গোল হলে তো কথাই নাই । গগন বিদারী চিৎকার আর করতালিতে মুখরিত হতো ঢাকা স্টেডিয়াম । বাংলাদেশের বিখ্যাত ফুটবলার সালাউদ্দীন, চুন্নু, সালাম মুর্শেদী, বাদল রায় আসলাম, রুমি, কায়সার হামিদ, আবুল, জনি, টুটুল, মোনেম মুন্না, সত্যজিৎ দাস রুপু, নকিব, সাব্বির, আলমগীরদের পাশাপাশি পাকির আলি, প্রেমলাল, এমেকা, নাসির হেজাজী, বোরহান জাদে, নালজেগার, সামির সাকির, করিমভ সহ বিশ্বের নানা দেশের ফুটবলারদের ক্রীড়া নৈপূন্যে উদ্ভাসিত ছিল ঢাকার ফুটবল মাঠ । ঢাকা লীগের বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান ফুটবলার কলকাতা মোহনবাগান সহ নামী দামি ক্লাবে তৎকালীন বাজার মূল্যে সর্বোচ্চ পারশ্রমিকে খেলতেন । তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অকাল প্রয়াত মোনেম মুন্না । ঢাকার মাঠ ছাড়িয়ে ঢাকাই ফুটবলের উত্তেজনার রেনু ছড়িয়ে পড়তো বাংলাদেশের হাটে মাঠে ঘাটে আনাচে কানাচে ফুটবল প্রেমীদের ঘরে ঘরে । খেলার আগের দিন নিজ নিজ দলের সমর্থকেরা বের হতো মিছিল নিয়ে । গলা ফাটাতো স্লোগানে স্লোগানে । চ্যাম্পিয়নশীপ নির্ধারণী ম্যাচের আগের দিন নিজ দলের ব্যানার সহ নগর-বন্দর, বাজার প্রদক্ষিন করতো সমর্থকেরা । কদাচিৎ উত্তেজনা ও সহিংসতার খবরও মিলতো । দলের জয় বা চ্যান্ম্পিয়নশীপ অর্জনে আনন্দ মিছিল এবং মিষ্টি বিতরন চলতো । রাইভাল দলকে খোঁচা মারাও চলত । তখন ট্রল শব্দের সাথে আমাদের তেমন পরিচয় ঘঠেনি । ফিরে আসি আবার ঢাকার মাঠে । রেফারির সিদ্ধান্ত নিজ দলের বিপক্ষে গেলে এবং সেই সিদ্ধান্তে জয় পরাজয় নির্ধারিত হলে এবং নিজ দল পরাজিত হলে ঢাকার মাঠ দেখেছে আবাহনী মোহামডানের উগ্র সমর্থকদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং হতাহতের চিত্র । এটা একপর্যায়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল যে কর্তৃপক্ষ ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে আবাহনী মোহমেডানের ম্যাচ আর্মি স্টেডিয়ামে দর্শক শুন্য মাঠে স্হানান্তর করতে বাধ্য হয়েছিল । এটা ঢাকার ফুটবলের ঐতিহ্যে কলংক লেপন করেছিল । অনেক স্টেডিয়ামে যেয়ে খেলা দেখতে ভয় পেতে শুরু করে । নব্বই এর দশকে ঢাকার মাঠে ফুটবল দেখতে দর্শকেরা দল বেঁধে আসতো । দলকে সমর্থন করতো । কালের বিবর্তনে ঢাকার মাঠের সেই ফুটবল হারিয়ে গেল অন্ধ গলিতে । তারপরও এদেশের মানুষের ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা প্রেম একটুও কমেনি বরং প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ইউরোপের শীর্ষ লীগের খেলা দেখার সুযোগে তা বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে । এখানেও গড়ে উঠেছে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, ম্যানসিটি, লিভারপুল, ম্যান ইউ, চেলসি, পিএসজি, জুভেন্টাস, এসি মিলান, বায়ার্ন মিউনিখ ফ্যান ক্লাব । বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা শিবিরে বিভক্ত হয়ে ফুটবল খেলা দেখার প্রচলন বাংলাদেশে টেলিভিশন সার্বজনীন হওয়ার শুরু থেকে । ধ্রুপদী ল্যাটিন ঘরানার ফুটবলের আকর্ষনের বাইরে কিংবদন্তী পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালদো, রোনালদিনহো, কাকা এবং মেসির ব্যক্তিগত নৈপূন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এ দেশের ফুটবল অনুরাগীরা ব্রাজিল আর্জেন্টিনা শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে । অন্য দেশেরও সমর্থক রয়েছে । সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্বকাপের একমাস ধরেই নিজের পছন্দের দলের খেলোয়াড় এবং খেলা নিয়ে মুহুর্মুহ স্ট্যাটাস, রাইভাল দলকে ট্রল করা সহ মেসি, নেইমার, এমবাপে, রোনাল্ডো- কে হবে বিশ্বসেরা, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ । পাড়া-মহল্লা, নগর-বন্দর, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছেয়ে ছিল প্রিয় দলের পতাকায়। প্রতিযোগিতা ছিল কে কত বড় দৈর্ঘের পতাকা তৈরী করবে। প্রিয় দলের শোভাযাত্রা এবং বিজয়ের পর আনন্দ মিছিল ছিল নিয়মিত চিত্র । বাংলাদেশের ফুটবল অনুরাগীদের ব্রাজিল আর্জেন্টিনার প্রতি ভালোবাসার বহি:প্রকাশ ব্যাপকভাবে বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষন করেছে এবং তা ফলাও ভাবে প্রকাশ ও করেছে। আর্জেন্টিনার নাগরিকেরা বাংলাদেশের ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট ফ্যান ক্লাবের সাথে যুক্ত হয়েছে । বিশ্বজয়ী সোনার ছেলে মেসির মা আর্জেন্টিনা এবং মেসিকে সমর্থন করায় বাংলাদেশেকে ধন্যবাদ জানিয়েছে । এ আমাদের বড় প্রাপ্তি । মেসির মায়ের প্রতি আমরা ভালোবাসা জানাই । মেসিকে নিয়ে বাংলাদেশ ভ্রমনের আমন্ত্রণ জানাই ফুটবল পাগল জাতিকে দেখার জন্য । বিশ্বকাপর উন্মাদনা তরুন প্রজন্মের মধ্যে বেশী বিরাজমান ছিল । এই উন্মাদনা সকল মাত্রাকে ছাড়িয়ে ১২টি তাঁজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে । বাবা মাকে করেছে সন্তান হারা, ভাই বোনকে করেছে ভাই হারা, আত্মীয়-স্বজনকে করেছে প্রিয়জন হারা । আহত হয়েছে প্রায় শতাধিক । একটি জেলায় ৩০০ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বিশ্বকাপের রাতে । এ কেমন ফুটবল প্রেম, এ কেমন অনুরাগ, এ কেমন ফুটবলীয় ভালোবাসা ? ফুটবলকে কেন্দ্র করে তারুন্যের এ সহিংস উন্মাদনার কারন অনুসন্ধান করে তা দুর করার জন্য এখনই তৎপর না হলে ভবিষ্যতে আরো হতাহতের ঘঠনা ঘটবে এবং এই উগ্র সমর্থকদের জন্য হালে অর্জিত প্রশংসা একদিন আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমে লজ্জা এবং ধিক্কারে পরিনত হবে । ফুটবল হোক নির্মল আনন্দের বাহন, সমর্থন হোক আবেগপূর্ন কিন্তু সহিংসতা বর্জিত । আবার ৪ বছর পর বিশ্বকাপ ফিরে আসবে, আমরা দলবেঁধে প্রিয় দলকে সমর্থন করব, ঢাকা লীগ জমে উঠবে সগৌরবে, বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বিশ্বফুটবল মঞ্চে , ব্রাজিল ২০২৬ এর বিশ্বকাপ জিতবে এই প্রত্যাশা রাখছি । লেখক: এস এম মোস্তফা কামাল, সাবেক জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা। সংবাদটি ৬৭৯ বার পড়া হয়েছে আপনার মতামত লিখুন : আরও পড়ুন আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস: কেন এই ভালোবাসা দিবস? কবিতা: “পথিক”