হরিঢালীতে সামাজিক বনায়নের মূল্যবান গাছ দফায় দফায় কেটে সাবাড়

প্রকাশিত: ৬:০৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২০ | আপডেট: ৬:০৬:অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২০

দক্ষিণ খুলনার সবুজ বেস্টনীর এক অনুপম সৌন্দর্য্যরে আধার পাইকগাছা উপজেলার হরিঢালী ইউনিয়নে সরকারী রাস্তার বৃক্ষরাজী কেটে সাবাড় করছে একটি চক্র। প্রায় ৫-৬ বছর যাবৎ এ চক্রটি বৃক্ষ নিধন যজ্ঞে মেতে থাকলেও এত দিন হুশ হয়নি প্রশাসনের। তবে বর্তমানে প্রশাসনের হুশ ফিরলেও ততক্ষণে প্রায় ৬৫ শতাংশ বৃক্ষ কেটে সাবাড় করেছে চক্রটি, আর এই চক্রের পোষ্য কাঠ ব্যাপারীর পকেটও ভারী হয়েছে এই মোক্ষম সুযোগে। উপকার ভোগীদের বঞ্চিত করে নিজেদের পকেট ভারি করায় এই মহোৎসবের সাথে জড়িতদের তদন্ত পূর্বক বিচার দাবি করেছেন এলাকাবাসী।

সোহাগ মাল্টিমিডিয়া এন্ড ট্র্যাভেলস

তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, উপকূলীয় অঞ্চল হরিঢালী ইউনিয়নের সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্টিকে অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য উত্তরণ (এনজিও) নামক একটি প্রতিষ্ঠান এ ইউনিয়নের ৮টি গ্রামে দীর্ঘ ২৬ কিলোমিটার সরকারী রাস্তার দু’ধারে বিভিন্ন ফলজ ও বনজ বৃক্ষ রোপন করে তা রক্ষানাবেক্ষণে নিয়োজিত থাকে। ২০১২ সালে এসব গাছ পরিপক্ক হওয়ায় বিধি মোতাবেক কিছু সংখ্যক গাছ কাটার প্রক্রিয়া শুরু করলে বাধা দেয় ‘হরিঢালী কৃষক সমবায় সমিতি লিঃ’ নামের একটি সংগঠনের কতিপয় সদস্য। এ সংগঠনের দাবি, এসব গাছ তারা রোপন করে এর রক্ষানাবেক্ষণ, পরিচর্যা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন প্রাপ্ত হয়ে ৩১৩ সদস্য বিশিষ্ট হরিঢালী কৃষক সমবায় সমিতির গঠন করা হয়েছে। উত্তরণের পক্ষে গাছ কাটায় বাধা আসলে উত্তরণ ২০১২ সালের ১১ এপ্রিল তৎকালিণ পাইকগাছা নির্বাহী কর্মকর্তার আদালতে উত্তরণের ব্যাবস্থাপক রিয়াজুল ইসলাম মামলা করেন। এর প্রেক্ষিতে তৎকালিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরেজমিনে তদন্ত পূর্বক উত্তরণকে বিক্রয়যোগ্য গাছ কাটার জন্য ৩০/৭/১২ তারিখে আদেশ দেন। কিন্তু এই আদেশের এক পর্যায়ে হরিঢালী কৃষক সমবায় সমিতি লিঃ এর তৎকালিণ সাধারণ সম্পাদক শেখ নাজিম উদ্দীন উত্তরণের ব্যাবস্থাপক, পরিচালক, হরিঢালী ইউপি চেয়ারম্যান, বিভাগীয় বন কর্মকতা ও উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকতাকে বিবাদী করে ১৪/৮/১২ তারিখে খুলনার যুগ্ম জেলা জজ ৪র্থ আদালতে একটি মামলা রুজু করেন। তবে এর আগে গাছ চুরির অভিযোগে উত্তরণ কর্তৃপক্ষ হরিঢালী কৃষক সমবায় সমিতির একটি দুষ্টু চক্রের বিরুদ্ধে ৮/৫/১২ তারিখে পাইকগাছা নির্বাহী আদালতে একটি মামলা করেন। সে মামলায় তার ক্ষমা প্রার্থনা করে ভবিষ্যতে এমন কাজ করবে না মর্মে উত্তরণের সাথে আপোষ মিমাংশা করার নিমিত্তে আদালতে মুচলেকা দেন।

সূত্র জানায়, হরিঢালী কৃষক সমবায় সমিতির লিঃ কর্তৃক দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তি না হলেও বিভিন্ন অজুহাতে কোন প্রকার ঘোষণা, বিজ্ঞপ্তি ও প্রচারণা ছাড়াই গত ৫-৬ বছর যাবৎ কোটি টাকার মূল্যের গাছ কাটছে নির্বিচারে। এলাকাবাসী বলছেন, এসব গাছ বিক্রির টাকা কোথায় গেলে? গাছ কাটার এই চক্রের সাথে অন্তরালে কারা জড়িত? একাধিক ব্যাপারীর গাছ কেনার আগ্রহ দেখালেও তাদেরকে বাদ দিয়ে গাছের প্রতিটি চালান এলাকার রুহুল আমিন মল্লিক নামের ব্যাপারী কাছে বিক্রয় করা হচ্ছে। এমন প্রশ্ন এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে।

এ সংগঠনের উপকারভোগী (সদস্য) গফ্ফার সরদার বলেন, ‘১২ বছর পূর্বে ডাল বিক্রিয় করে ৭০ টাকা দিয়েছে, তা ছাড়া আর কোন টাকা দেয়নি। এসবের প্রতিবাদ করলে আমাকে হুমকি দেয়।’ সদস্য মৃত্যুঞ্জয় দত্ত বলেন, ‘এ সংগঠনের সভাপতি মুন্সি শাফায়েত হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ লিটনসহ আরও ৫/৬ জন এসব গাছ বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। উপকারভোগী মৃতঃ শামছুর রহমান গাজীর স্ত্রী শাহিদা বেগম (৪০) জানান, ‘কয়েক দিন আগে মাত্র ১৮০ টাকা পেয়েছি।’

হরিঢালী কৃষক সমবায় সমিতির সভাপতি মুন্সি শাফায়েত হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা হরিঢালী ইউপি চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে গাছ কেটেছি। এ যাবৎ যে গাছ কেটেছি তার লভ্যাংশ চেয়ারম্যান, বি আর ডিপি, বন বিভাগ ও উপকারভোগীদের দিয়েছি।’ শেষ দফার কাঠের বড় চালানের অবশিষ্ট অংশ পুলিশ জব্দ করলো কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পুলিশ অন্যায় করেছে।’

মামলা চলমান থাকাকালীণ কেন গাছ কাটা হল, এমন প্রশ্নের জবাবে সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ লিটন বলেন, ‘কিছু গাছ নুয়ে পড়েছিল, আর আম্পানের কারণে মোট ৩০/৩৫টি গাছ রাস্তার উপর ঝুকে পড়েছিল তাই সাবেক ইউএনও জুলিয়া সুকায়নার দপ্তরে আবেদন করলে তিনি বন বিভাগের অনুমোদন করিয়ে গাছ কাটার নির্দেশনা দেন বলে গাছ কেটেছি।’

এবিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান আবু জাফর সিদ্দীক রাজু’র বক্তব্য নেওয়ার জন্য তার ইউপি কার্যালয়ে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি, এমনকি দুই দিন কয়েক দফায় তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি।’

উত্তরণ পরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘৯৬ সালে আমাদের ৭ হাজার গাছ লাগানোর পর প্রায় ৭ বছর পরে কৃষক সমিতি নামের সংগঠনটি দু’এক জায়গায় কিছু গাছ রোপন করে, তবে তার সংখ্যা খুবই কম। নানা বিতর্কের পরও ঐ এলাকার সুবিধা বঞ্চিত নারীদের মাঝে সমন্বিতভাবে গাছ বিক্রির টাকাগুলো বিতরণের জন্য হরিঢালী ইউপি চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বলার স্বত্তেও তা উপেক্ষিত হয়েছে।’

উপজেলা বন কর্মকর্তা প্রেমানন্দ রায় বলেন, ‘সম্প্রতি যে গাছগুলো কাটা হয়েছে সেগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়নি।’
জানাযায়, গাছ বিক্রি চক্রের শেষ দফার কাঠের একটা বড় চালান ব্যাপারী রুহুল আমীনের মাধ্যমে বিক্রি করে ট্রাক যোগে দেশের অন্যত্রে পাঠানো হয়। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম খালিদ হোসেন সিদ্দিকীর নির্দেশে কাঠের চালানের অবশিষ্ট প্রায় এক লক্ষ টাকা মূল্যের ২৫ পিচ মূল্যবান রোড শিরিশ কাঠ হরিঢালী ক্যাম্প পুলিশ জব্দ করেছে।

 


আপনার মতামত লিখুন :

এইচএমএ হাশেম। নিজস্ব প্রতিবেদক। কপিলমুনি, খুলনা