বঙ্গবন্ধু একজন সাহসী বীর: স্কুল জীবনেই হয় আন্দোলনের হাতে খড়ি প্রকাশিত: ১২:০১ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৭, ২০২০ | আপডেট: ১২:০১:অপরাহ্ণ, মার্চ ১৭, ২০২০ বঙ্গবন্ধু একজন সাহসী বীর: স্কুল জীবনেই হয় আন্দোলনের হাতে খড়ি ।। পলাশ কর্মকার ।। মানব সভ্যতার বিকাশ প্রক্রিয়ায় এক এক জন যুগ স্রষ্টার আবির্ভাব সমাজ কে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যায়। এসব মনীষীর জীবন কথা সমাজের অগ্রগতিতে তাঁদের ভূমিকা উদ্ভাসিত হয়; আবার জনগোষ্ঠীগুলির আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দিক সমূহেরও উন্মোচন ঘটে। বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমন এক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়। সময়টা ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। জন্মস্থান ঢাকা হতে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তাঁর মা সাহেরা খাতুন গৃহবধু, পিতা শেখ লুৎফর রমহান। পিতা ছিলেন জেলা জজ আদালতের সেরেস্তাদার। কিশোর মুজিবের সাহসীকতার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ১৯৩৯ সালে। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা একে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ মিশন সাকুল পরিদর্শনে গেলে স্কুলের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের পথ রুদ্ধ করে স্কুল বোর্ডিং এর ছাদ মেরামত করার দাবি করেন। সেখানে তাঁর দাবী মেনে নেওয়া হয়। এভাবে মুজিবের আন্দোলনের হাতেখড়ি হয়। ১৯৪২ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গোপালগঞ্জ মহাকুমা মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সম্পাদক স্পষ্টবাদী, সাহসী ও উদ্যমী মুজিব কলকাতায় ইসলামীয়া কলেজে পড়ার সময় বেকার হেস্টেলে থাকতেই অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের কারণে সোহ্রাওয়র্দিী, ফজলুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দের আস্থা অর্জন করেন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে ফরিদপুর জেলার কর্মভার দলের পক্ষ হতে তাঁর উপর অর্পিত হয়। ইতোমধ্যে তিনি কলেজে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৪৭ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। মুজিবসহ কয়েকজন ছাত্রনেতার উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু দৃঢ় ভূমিকা রাখেন। সরকার তাঁকে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ও পরবর্তীতে একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর জেলে পাঠান। ঢাকার রোজ গার্ডেনে ১৯৪৯ এর ২৩ জুন প্রধানত মুসলীম লীগের প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে “আওয়ামী মুসলিম লীগ” গঠিত হয়। কারাবন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধু দলের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ এর ফেব্রুয়ারীর শেষে মুক্তির পর মুজিব প্রাদেশিক আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামীলীগ নেজামে ইসলামী, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও গণতন্ত্রী দল ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনী মোর্চা, যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। নির্বাচনে পরিষদের ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩ টি আসন লাভ করে। সরকারী দল মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন। একজন কোটিপতি মুসলিম লীগ নেতার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামান তেরো হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হলেন। তিনি ১৯৫৫ সালে কেন্দ্রীয় গণপরিষদেরও সদস্য নির্বাচিত হন। শেখ মুজিব এ সময় কেন পূর্ববঙ্গে আটনমি চাই, শীর্ষক এক পুস্তিকা আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে প্রকাশ করে পূর্ব বাংলার উপর উপনিবেশিক শোষণ ও পশ্চিম পাকিস্তানের বাজারে পরিণত করার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জনগণকে সচেতন করতে শুরু করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে দলের নাম হতে “মুসলিম” কথাটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব আনলে সর্বসম্মতভাবে তা গৃহীত হয়। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে সামরিক আইন জারী করেন। বিশ দিন পর সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে, এবং নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষনা করেন। প্রেসিডেন্ট আয়ুবের নীল নকসা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসিত একটি মৌলিক গণতন্ত্র সংবিধান ১৯৬২ সালের ১ মার্চ তারিখে প্রবর্তিত হয়। সামরিক আইন জারীর সাথে সাথে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার এবং ১৪ মাস কারাভোগের পর ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি মুক্তি পান। ১৯৬২ -র ২৪ জুন মুজিবসহ পাকিস্তানের নয় জন নেতা ঘোষনা করেন যে, গণপ্রতিনিধি ছাড়া আর কেউ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার রাখেন না। মুজিবের প্রস্তাব ক্রমে ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটি দলকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। পার্লামেন্টরী ধরণের গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও পূর্ব পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার দাবী উত্থাপিত হয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ ও পরবর্তীতে তাসখন্দ চুক্তির প্রেক্ষাপটে পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রিক নেতারা ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলন আহবান করলে বাঙালির জাতীয় মুক্তি ও পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তাহীনতার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ঐ সভায় তাঁর ঐতিহাসিক “ছয় দফা” কর্মসূচি উত্থাপন করেন। কর্মসূচি ১৮ মার্চ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে “আমাদের বাঁচার দাবী ছয় দফা কর্মসূচি” শিরোনামে ব্যাখ্যাসহকারে বিলি করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জানুয়ারী প্রায় দু’বছর কারাবাস শেষে মুক্ত হয়ে বের হওয়ার পরই আইয়ুব সরকার ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে শেখ মুজিব ও আরো ৩৪ জনের বিরুদ্ধে“আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলা দায়ের করে। অভিযোগ, এঁরা ভারতের আগরতলায় বসে ভারত সরকারের যোগসাজেশ পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। প্রধান আসামী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ এর ২৮ জানুয়ারী এক দীর্ঘ জবানবন্দীতে তাঁর সংগ্রামী নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও পূর্ব বাংলার প্রতি শাসকগোষ্ঠীর উপেক্ষা, বঞ্চনা ও অপশাসনের বিষয়ে নিজের ও তাঁর দলের দৃষ্টিভংগির বিবরণ দেন। গণআন্দোলনের শক্তি বুঝতে পেরে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ১৯ ফেব্রুয়ারী রাওয়ালপিন্ডিতে বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে আলোচনায় বসার আহব্বান জানান। ২২ ফেব্রুয়ারী এক ঘোষণায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও মুজিবসহ সকল আসামীকে মুক্তি দেয়া হয়। পরদিন “কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহব্বানে রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ছাত্ররা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধীতে ভূষিত করে। ” এক সামরিক অভ্যুত্থানে ২৫ মার্চ অপসারণ করে সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হন। তিনি কঠোর হাতে জনশৃঙ্খলা রক্ষা ও যথাশীঘ্র সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সংকল্প ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র ৬৭ দিনের মধ্যে তাঁর বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমত্তার গুণে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার নিশ্চিত করেন। তিনি দ্রুত একটি সংবিধান প্রবর্তনের প্রতি মনোনিবেশ করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করেন। বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকীতে গণপরিষদ জাতিকে একটি উৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দেয়। পাকিস্তান হতে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালির প্রত্যাবর্তন ও তাদের পুনর্বাসন, দেশে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা, হাজার হাজার অস্ত্র উদ্ধার, অর্থনীতির পুনরজ্জীবন, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা রুপায়ন, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি ও সহায়তা সংগ্রহ ইত্যাদি দুরহ কাজে বঙ্গবন্ধুকে দিবারত্রী পরিশ্রম করতে হয়েছে। “ মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দানের জন্য বিশ্ব শান্তি পরিষদের কাছ থেকে তিনি জুলিও কুরী পুরস্কার পেয়েছিলেন।” বঙ্গবন্ধু সব সময় মানুষকে অন্ধভাবে ভালোবেসে নিজের নিরাপত্তার কথা উপেক্ষা করেছেন। তাঁর অনুগৃহীতদের সবার মধ্যে দেশ প্রেমের সমান অনভূতি তিনি সৃষ্টি করতে সমর্থ হন নি। ফলে এদের কেউ কেউ তাঁর মহত্বকে পূজি করে স্বার্থ উদ্ধার ও দেশের ক্ষতি করেছে। এসব স্বত্বেও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন বাঙালি জাতিকে দিশাহীন ছন্নছাড়া অবস্থা হতে উদ্ধারে রিলস চেষ্টা করেছিলেন। যা বাংলাদেশ শুধু নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ আজও শ্রদ্ধাভরে স্বীকার ও স্মরণ করছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের প্রথম প্রহরে রক্তচোষা খুনিরা ধানমন্ডির বাসভবনে নির্মমভাবে জাতি শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট সংবাদটি ২৬০ বার পড়া হয়েছে আপনার মতামত লিখুন : আরও পড়ুন “হরিষে বিষাদ” আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস: কেন এই ভালোবাসা দিবস?