চুকনগর গণহত্যা স্মৃতি বধ্যভূমি: অযত্ন অবহেলায়, আশ্বাস আর বাণীতে কেটে গেছে ১৪ বছর প্রকাশিত: ২:৫৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৭, ২০২০ | আপডেট: ২:৫৫:অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৭, ২০২০ চুকনগর গণহত্যা-৭১ স্মৃতিরক্ষা বধ্যভূমি। “হবে আর করব” এই আশ্বাস বাণীতে কেটে গেছে ১৪ বছর। ২০০৬ সালে নির্মিত চুকনগর গণহত্যা-৭১ স্মৃতিরক্ষা বধ্যভূমিটি আজও পূর্ণতা পায়নি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে অযত্ন অবহেলায়। গত ১৪ বছরেও এর কোন সংস্কার হয়নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এখানে সংঘঠিত হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণহত্যা। ১৯৭১ সালের ২০ মে এখানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনী হানা দেয়। ব্রাশ ফায়ার করে প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হয় খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে। রচিত হয় চুকনগর গণহত্যার ইতিহাস। বাংলাদেশ শুধু নয়, ইতোপূর্বে সংঘটিত বিশ্বের সকল গণহত্যার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে চুকনগর গণহত্যাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণহত্যা। এত অল্প সময়ে এক জায়গায় এতগুলো মানুষকে হত্যার নজির কেথাও খুজেঁ পাওয়া যাবেনা। যেভাবে সংঘটিত হল ইতিহাসের বর্বরচিত এই গণহত্যা: ১৯৭১ সাল সারাদেশ জুড়ে শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। এরমধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ প্রাণভয়ে পালাচ্ছে দেশ ছেড়ে। তেমনি একটি দিন ২০ মে। আগের দিন ১৯ মে বিকেল থেকেই খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, বাগেরহাটের রামপাল, মংলা, শরনখোলা সহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ গরুর গাড়ি ও নৌকায় করে জড়ো হয় চুকনগরে। উদ্দেশ্য, পরদিন সকালে সাতক্ষীরার ভোমরা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়া। তারা আশ্রয় নেয় চুকনগর বাজারের কালীবাড়ি, চাদঁনী, ফুটবল মাঠ, হাইস্কুল মাঠ, পাতিখোলা বিলের পাড়সহ বিভিন্ন স্থানে। পরদিন সকালে সাড়ে আটটার দিকে পাতিখোলা বিলের পশ্চিম প্রাণ্তে চুকনগর-সাতক্ষীরা সড়কের ঝাউঁতলায় এসে থামে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দুটো জীপ।জীপ থেকে নেমে বিলে দিকে অগ্রসর হতেই পিাট ক্ষেতে কাজ করতে থাকা মালতিয়া গ্রামের কৃষক চিকন আলী মোড়ল হাতের নিড়ানী উচিঁয়ে প্রতিবাদ করে। সাথে সাথে গর্জে ওঠে পাক হানাদার বাহিনীর রাইফেল। তারা প্রথমে গুলি করে হত্যা করে চিকন আলী মোড়লকে। এরপর তার একটু দুরে থাকা একই গ্রামের সরেন কুন্ডুকেও হত্যা করা হয়। এরপর নিরিহ নিরস্ত্র মানুষের উপর চলতে থাকে হায়েনাদের ব্রাশফায়ার। হায়েনারা নসেদিন কাউকে রেহাই দেয়নি, নারী, পুরুষ, যুবক, বৃদ্ধ, শিশু, কিশোর সবাইকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের এই হত্যাযজ্ঞ স্থায়ী ছিল দুই ঘন্টার মত, এই দুই ঘন্টায় কত মানুষ যে আত্মাহুতি দিয়েছে তার সঠিক হিসাব কেউ দিতে পারবেনা। তবে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ননা মতে প্রায় ১০ হাজার মানব সন্তানকে সেদিন হত্যা করেছিল হানাদার বাহীনি। কিন্তু বাস্তব সত্য হল স্বাধীনতার ৩৪ বছর পার হলেও ২০০৫ সাল পর্যন্ত কোন সরকারের সময় চুকনগরে একটি বধ্যভূমি নির্মিত হয়নি। অবশেষে ২০০৫ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৪দলীয় জোট সরকারের সময় পাতিখোলা বিলের দক্ষিণ-পূর্বকোনে মালবতয়া মৌজায় বধ্যভূমির জন্য .৭৮ শতক জমি অধিগ্রহণ করে এবং ২০০৬ সালে ১৯৭১ সালের ২০মে গণহত্যায় নিহতদের স্মৃতি রক্ষার্থে ৩২ শতক জমির উপরে নির্মিত হয় গণহত্যা-৭১ স্মৃতি বধ্যভূমি।এর কিছুদিন পরেই শেষ হয় সরকারের মেয়াদ, তারপর থেকে অদ্যাবধি একটানা তৃতীয় বারের মত ক্ষমতায় আওয়ামীলীগ সরকার। কিন্তু অজ্ঞাত কারনে এই ১৪ বছরে বধ্যভূমিটির কোন উন্নয়ন বা সংস্কার চোখে পড়েনি। এর মধ্যে সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা, সচিব সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির আগমন ঘটেছে এখানে।সকলের কাছে দাবিও তোলা হয়েছে বধ্যভূমির কলেবর বৃদ্ধি এবং একটি কমপ্লেক্স নির্মানের কিন্তু সবাই শুধু হবে আর করব এই আশ্বাস বাণীই শুনিয়েছেন, বাস্তবে আজও ১৪ বছর আগের অবস্থাতেই রয়ে গেছে বধ্যভূমিটি। গণহত্যা-৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদ ও এলাকবাসীর পক্ষ থেকে তাদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে বধ্যভূমিরি বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নের দাবি। সকলের কথা একটাই সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানাব আর খুব শিঘ্রি পদক্ষেপ গ্রহণ করব কিন্তু অদ্যাবধি বধ্যভূমিটির কোন উন্নয়ন চোখে পড়েনি। অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি, পেয়েছি একটি পতাকা ও মানচিত্র। অথচ গণহত্যার সাক্ষী এ স্থান বলতে গেলে সারা বছরই পড়ে থাকে অবহেলায়। বধ্যভূমির সামনের ফটক খোলা থাকার কারনে এখানে মাদকসেবী ও কপোত-কপোতির আড্ডা জমে বলেও এলাকাবাসীর অভিডযাগ রয়েছে। খুলনা শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমে ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের চুকনগরে গিয়ে সেখানে বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ দেখা যায়। কিন্তু নামফলক বা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে না। স্মৃতিস্তম্ভের বেদির পেছনের অংশে বড় একটি ফাটল রয়েছে। এক পাশের এক সারি ইট উঠে গেছে। সীমানাপ্রাচীরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনার একটি বড় অংশ সম্পূর্ণ ভাঙা ছিল তবে গত ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে বিষয়টি নজরে পড়ে ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গাজী এজাজ আহম্মেদ ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আব্দুল ওয়াদুদের। এসময় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষনিক বরাদ্দ দিয়ে সেটি সংস্কার করা হয়। উপজেলা প্রশাসন ও চুকনগর গণহত্যা-১৯৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদের উদ্যোগে এখানে গণহত্যার দিন ২০ মে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে ফুল দেওয়ার মতো ছোটখাটো অনুষ্ঠান হয়। বধ্যভূমি রক্ষনাবেক্ষণ করার জন্যে জন্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একজন কেয়ারটেকার নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি হলেন, মালতিয়া গ্রামের ফজলুর রহমান মোড়ল। তিনি এ প্রতিবেককে জানান, বধ্যভূমি পরিদর্শন করে শিগগিরই পূর্ণতা দেয়ার জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করার কথা বলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব। চুকনগর গণহত্যা-১৯৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদ’র সভাপতি চুকনগর ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এবিএম শফিকুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ ও পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়নি। তাঁর দুঃখ, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র’র ১৫ খণ্ডের কোথাও চুকনগরের গণহত্যার কথা উল্লেখ নেই। অথচ ইতিহাস স্বাক্ষী এখনও চুকনগর গণহত্যাই হল বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণহত্যা। তিনি বলেন, প্রতি বছর ২০ মে নিজেরা যতটুকু পারি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। সরকারি প্রতিশ্রুতি কখনোই পূরণ হয় না। কেবল স্মৃতিসৌধের মূল স্তম্ভটি হয়েছে। যতদ্রুত চুকনগর বধ্যভূমির পূর্ণতা দেওয়া যায়, সেজন্য জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখা হবে। খুব শিগগিরি এজন্য আবেদন করা হবে। সংবাদটি ১২০০ বার পড়া হয়েছে আপনার মতামত লিখুন : আরও পড়ুন চুকনগরে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করায় ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা চুকনগরে ইঞ্জিন ভ্যান চালাতে গিয়ে ৬ বছরের শিশুর করুন মৃত্যু